
“লাল মানেই মরিচা নয়: বাংলাদেশে কনস্ট্রাকশন রডের গুণগত মান নিয়ে সঠিক ধারণা”
বাংলাদেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং সেই সাথে কনস্ট্রাকশন রড বা রিবারের চাহিদা ও উৎপাদনও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে অনেকের মধ্যে রডের রঙ পরিবর্তন নিয়ে ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই মনে করেন, রডের রঙ লাল বা বাদামী হলে এটি মরিচা ধরেছে এবং মানে খারাপ হয়ে গেছে। তবে এটি সম্পূর্ণ ভুল। রডের গুণগত মান কি আসলেই পরিবর্তিত হচ্ছে? চলুন বিস্তারিত জানি।
বাংলাদেশে কনস্ট্রাকশন রডের চাহিদা বৃদ্ধি
বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে কনস্ট্রাকশন রডের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বর্তমানে, দেশে বছরে প্রায় ৮৭ লাখ মেট্রিক টন কনস্ট্রাকশন রড উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে, যার বিপরীতে চাহিদা প্রায় ৫৫ লাখ থেকে ৬০ লাখ মেট্রিক টন। এই চাহিদা মেটানোর জন্য বাংলাদেশের ৩৫টি বড় ও ছোট কোম্পানি কাজ করছে, এবং প্রতিনিয়ত এটি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কেন কনস্ট্রাকশন রড লাল বা বাদামী হয়ে যায়?
সাধারণত, কনস্ট্রাকশন রডের বা রিবারের রঙ কালচে হয়। কিন্তু কিছু রড লাল বা বাদামী রঙে পরিণত হতে পারে। এটি দেখে অনেকেই মনে করেন যে রডে মরিচা ধরেছে। তবে, এটি সম্পূর্ণরূপে ভুল ধারণা।

মরিচা কীভাবে সৃষ্টি হয়?
মরিচা বা করোসন তখনই ঘটে, যখন লোহা বাতাসের অক্সিজেন এবং পানির সংস্পর্শে আসে। রাসায়নিকভাবে এটি ফেরিক অক্সাইড (Fe(OH)₃) নামক পদার্থে পরিণত হয়। যে মুহূর্তে লোহা উৎপাদিত হয়, তা অবিলম্বে বাতাসের অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসে। এছাড়াও, বিভিন্ন পরিবেশ যেমন বৃষ্টি, আর্দ্রতা, লোডিং-আনলোডিং বা সাইটের পানি, এসবের মাধ্যমেও রডে পানির সংস্পর্শ হতে পারে।
কি মনে হয়, এর ফলে কি রডের গুনগত মান পরিবর্তন হয়ে যাবে ?
উত্তরটি হলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই “না”, যদি না আপনি ক্রমাগত পানির মধ্যে রডকে মাসের পর চুবিয়ে না রাখেন ,কিংবা ক্রমাগত পানির ঝর্ণার নিচে এটিকে না রাখেন।যা কিনা আমরা কেউই করিনা।
রডের গুণগত মান নির্ভর করে তিনটি জিনিসের উপর:
১) সঠিক ডায়ামিটার: রডের আকার সঠিক হতে হবে যাতে এটি কাঠামোতে যথাযথ শক্তি প্রদান করতে পারে।
২)) সঠিক রাসায়নিক অনুপাত: লোহার রাসায়নিক উপাদান যেমন কার্বন, ম্যাঙ্গানিজ ইত্যাদি সঠিকভাবে মেশানো থাকা জরুরি।
৩) মাইক্রোস্ট্রাকচার: রডের বাইরের এবং ভিতরের স্তরের সঠিক অনুপাত নিশ্চিত করতে হবে।
প্রাথমিকভাবে রডে যে লালচে কিংবা লাল/ বাদামী ধরণের রং হয় তা মরিচার প্রারাম্ভিব স্তর মাত্র।যার ফলে আপনি কখনই রডের গায়ে হাত দিয়ে কোন গুঁড়াগুঁড়া কিছু পাবেন না।অর্থাৎ রডের বিন্দুমাত্র ক্ষয় হয় নি,অর্থাৎ রডের ডায়ামিটার দশমিক শূন্য এক ভাগ ও পরিবর্তিত হয়নি।আর রাসায়নিকভাবে ব্যাপক পরিবর্তনের তো প্রশ্নই উঠেনা।অতএব,আপনাদের রডের গুণগতমানের কোনোই পরিবর্তন হয় নি।তাই আমাদের উচিৎ এই ধরণের লালচে/ বাদামী হয়ে যাওয়া রড নিয়ে মনের মধ্যে কোনরূপ সংশয় না রাখা।
মরিচা/রাস্ট/করোশন যাই বলেন না কেন,এই গুলো নিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অনেক দিক নির্দেশনা দিয়েছেন।
আমেরিকান কংক্রিট ইনস্টিটিউট (এসিআই)-৩০১(২০০৫) এর মতে
“যখন কংক্রিট স্থাপন করা হবে,বন্ডের/বন্ধনের জন্য সমস্ত শক্তিবৃদ্ধি ক্ষতিকারক উপাদান থেকে মুক্ত হতে হবে।”
এসিআই-৩১৮(২০০৮) এর মতে
”মরিচা, মিল স্কেল, বা উভয়ের সংমিশ্রণের সাথে ইস্পাত শক্তিবৃদ্ধি সন্তোষজনক বলে বিবেচিত হবে,যদি ন্যূনতম মাপ/আয়তন (বিকৃতির উচ্চতা সহ) বজায় থাকে এবং একটি হাত-তার-ব্রাশ পরীক্ষার নমুনার ওজন প্রযোজ্য এএসটিএম (আমেরিকান সোসাইটি ফর টেস্টিং এন্ড ম্যাটেরিয়াল) স্পেসিফিকেশন মেনে চলে…”
আমেরিকান এসোসিয়েশন অফ স্টেট্ হাইওয়ে এন্ড ট্রান্সপোর্টেশন অফিশিয়ালস (২০০২) এর মতে
” ইস্পাত/রড কে অবশ্যই ধাতব আঘাত এবং মরিচা উত্পাদনকারী অবস্থার সংস্পর্শে সৃষ্ট পৃষ্ঠের ক্ষয় থেকে রক্ষা করে রাখতে হবে।যখন কাজে লাগানো হবে তখন যেন এর পৃষ্ঠ ময়লা, আলগা মরিচা বা স্কেল, মর্টার, পেইন্ট, গ্রীস, তেল বা অন্যান্য নন -ধাতব আবরণ থেকে মুক্ত থাকে যা বন্ধনকে হ্রাস করে।রডকে ক্ষতিকারক ত্রুটি যেমন ফাটল এবং স্তরিতকরণ থেকে মুক্ত থাকতে হবে।বন্ডেড মরিচা ,সারফেস সিমস,সারফেস অনিয়ম,বা মিল স্কেল প্রত্যাখ্যানের কারণ হবে না,যদি হাতের তারের ব্রাশ নমুনার ন্যূনতম মাত্রা,ক্রস-সেকশনাল এলাকা এবং প্রসার্য বৈশিষ্ট্যগুলি স্টিলের নির্দিষ্ট আকার এবং গ্রেডের জন্য শারীরিক প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে ।“
গ্রহণযোগ্য মরিচা:
একটি রডে মরিচা স্তরের পরিমাণ নির্ণয়ের ক্ষেত্র এখন একটি সাধারণ ব্যাপার হয়ে ওঠেছে,বিশেষ করে যখন কেউ পরিদর্শন দৃষ্টিকোণ থেকে রড দেখার দেখার সময় পায় ।নতুন রড যখন ডেলিভারি হয় , কিংবা সাইটের মজুদ থাকে , কিংবা তা দিয়ে যখন কাজ করা হয়,তখন রডে মরিচা ধরা স্বাভাবিক বলে মনে করা উচিত।
আপনার রডে মরিচা পড়লেও তা যেসব ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য, চলুন জেনে নেই,:-
১) হালকা মরিচা: এই মরিচা লাল, কমলা বা হালকা বাদামী রঙ দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।ইস্পাতের উপর মরিচার পরিমাণ ,পুরুত্ব, আর্দ্রতা পরিস্থিতি, পরিবেশগত এক্সপোজার এবং বারের বয়সের উপর নির্ভর করে।যদি বাহ্যিক এইসব বৈশিষ্টের তেমন একটা পরিবর্তন না হয় তবে এই ধরণের মরিচা কাঠামোগত উদ্বেগ নয়।
২) মরিচা যদি শক্তভাবে লেগে থাকে:যদি মরিচা শক্তভাবে বারের/রডের সাথে লেগে থাকে, তাহলে মরিচা বারের চারপাশের কংক্রিটের বন্ড/বন্ধনের বৈশিষ্ট্যগুলিকে উন্নত করবে।এই জং অপসারণের দরকার নেই।এটি ব্যাবহার যোগ্য।
৩) খোলা জায়গায় মরিচা ধরা: গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, রডকে খোলা জায়গায় ১৮ থেকে ২৪ পর্যন্ত রাখলেও এর বাহ্যিক কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয় না।যদিও এটি দেখতে ভালো না দেখালেও পরীক্ষাগারে একই রকম ফল দেখাবে যেমনটা নাকি নতুন অবস্থায় ছিল।
জং ধরা বা মরিচা ধরা আমরা তখনই বলতে পারি যখন এটি ভারী মোটা আকারের আবরণ হবে , ফেটে যাবে , বা চলটা ধরে বা আস্তর ধরে উঠে আসবে।এর মধ্যেও যদি কোন ভারী মরিচা বা পুরু জং রডের গায়ে এমনভাবে লেগে থাকে যেন সেটি রড থেকে অবিচ্ছিন্ন, তবে সেটিও ব্যাবহার করা যাবে।
এছাড়াও জানুয়ারি ২০০৪-এ এএসটিএম এর একটি পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে
২% পর্যন্ত মরিচা এরকম বা হালকা মরিচা যেটা ২% পর্যন্ত রডের বাহ্যিক আকার আয়তনে প্রভাব ফেলে,সেইসব মরিচা কংক্রিটের সাথে রডের বন্ধনকে আরও বেশি দৃঢ় করে।
অর্থাৎ আপনি যেই রডটি খারাপ রড হিসেবে বিবেচিত করছেন,তাহাই আপনার জন্য উল্টো আশীর্বাদ স্বরূপ
ইঞ্জি: মোহাম্মদ গোলাম হোসেন ফারহান
কংক্রিট রেইনফোর্সিং স্টিল ইনস্টিটিউট (সিআরএসআই) এর একটি গবেষণা পত্রে তারা বলছেন যে ,
” রডের উপর মরিচা পরা মানেই খারাপ অবস্থা নয়।বর্তমানে যে রক্ষণশীল মনভাব পোষণ করে মরিচা পরিষ্কার করার বাধ্যতামূলক একটি প্রচলন আছে ;এটি গবেষণা প্রমাণ দ্বারা সম্পূর্ণরূপে সমর্থিত নয়।এইসব জানা সত্ত্বেও, বেশিরভাগ প্রকৌশলী এবং পরিদর্শক একইভাবে রেইন্ফোর্সিং বার থেকে এই জাতীয় সামগ্রী অপসারণের প্রয়োজনীয়তায় রক্ষণশীল পদ্ধতি গ্রহণ করেন।মরিচা, রড/বারের চারপাশের কংক্রিটের বন্ড/বন্ধনের বৈশিষ্ট্যগুলিকে উন্নত করতে পারে।স্পষ্টতই, আলগা উপাদান রড/বার থেকে সরানো উচিত।তবে,বেশিরভাগ সময়ই আলগা উপাদানগুলো রড বহন,স্থানান্তর ও কাজের সময় ধাতব আগাতে ঝরে পরে।
মরিচা যেটা শক্তভাবে রডের গায়ে লেগে থাকে তা বন্ধনের জন্য ক্ষতিকর হবে না।
অতএব, সিআরএসআই বারগুলিকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক বিকাশের জন্য অতিরিক্ত মরিচা পরিষ্কারের ব্যবস্থাগুলি বাধ্যতামূলক করে,এমন কোনও প্রয়োজনীয়তা অনুমোদন করে না।”
আচ্ছা একটি প্রশ্নের উত্তর দেন তো ,
অসম্পূর্ণ কলামের কিংবা সিঁড়ির রড যেটা হরহামেশাই বাড়ির ছাদে দেখা যায় বছরের পর পরে থেকে লাল হতে হতে খয়েরি হয়ে যায় কিংবা কালচে খয়েরি হয়ে যায় ,সেগুলোতে কখনও কোনো বাড়ির মালিক কিংবা কোন প্রকৌশলীকে ফেলে দিতে দেখা যায় না।লেপিং লেংথের ক্ষেত্রেও কোন ছাড় তখন দেখা যায় না।
তাহলে নতুন রডের ক্ষেত্রে কেন এই বিমূখতা !!!
বিশ্ব যেখানে অনেক আগেই এই ব্যাপারটি মেনে নিয়েছে,তখনও আমরা পিছিয়ে আছি রক্ষণশীলতার বেড়াজালে।
অতএব,”লাল মানেই মরিচা নয়,মরিচা মানেই রড খারাপ নয়”
তথ্যসূত্র:
https://link.springer.com/article/10.1007/BF02829078
আমার এই লেখাটি ২৩ সেপ্টেম্বর ,২০২১ তারিখে বাংলা ডেইলি টুয়েন্টি ফোর ডট কম এ প্রথম প্রকাশিত হয়।
যার লিংক নিচে দেয়া হলো:
Your writing skills are amazing! I really love it! Can you review my website https://www.gdiz.eu.org and maybe you can share tour thought about mine?